#আনন্দ_অশ্রু
ঘটনাটা আজ থেকে কয়েকমাস আগের। মর্নিং ওয়াক এ পার্কে যেতেই দেখি একজন মহিলা বসে বসে কাঁদছে। খুবই কৌতুহল নিয়ে কাছে গেলাম। দেখে মনে হলো খুব তৃষ্ণার্ত। হাতে থাকা পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম বোন পানিটা খেয়ে নিন।
মহিলাটি কোন ইতস্তত বোধ না করে বোতলের পুরো পানিটা পান করলো।
- ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। কাঁদতে কাঁদতে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিলো।
- কাঁদছিলেন কেন? কোন কিছু হারিয়ে গেছে?
- কোন কিছু হারিয়ে যায়নি ভাই, নিজেকেই নিজে হারিয়ে ফেলেছি।
আমি বুঝতে পারলাম মহিলাটির মনে অনেক কষ্ট জমে আছে। কাউকে হয়তো শেয়ার করার জন্যও পাচ্ছে না। এইজন্য পার্কে বসে বসে কাঁদছে। কত ধরনের মানুষ যে এই পার্কে আসে। মহিলার ব্যপারে জানতে আমার খুব আগ্রহ হলো।
- আমাকে কি খুলে বলা যায় বোন?
- এসব বলে আর কি লাভ ভাই?
- কোন ক্ষতি তো নেই। তাছাড়া একটা লাভ হবে।
- কি লাভ হবে?
- কষ্ট কারো সাথে শেয়ার করলে মনটা অনেক হালকা হয়।
- তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমি এমনি অভাগী মেয়ে জীবনের কোন কিছু শেয়ার করার মতো কেউ নেই আমার।
- ভাই হিসেবে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।
- শোনেন তাহলে।
আমার বাড়ী টাঙ্গাইলে। নাম ফাতেমা। টেন পর্যন্ত স্কুলে পড়েছি। ছাত্রী হিসেবে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি। যাকে বলে নো মেট্রিক নাইন পাশ।
আমরা ছিলাম ৩ বোন, আমি সবার ছোট।
টেন এ উঠার পর হঠাৎ করেই বাবা মারা যায়। সংসার চালানোর কেউ ছিলোনা। তাই মামারা আমার বিয়ে দিয়ে দেন বিদেশ ফেরত এক লোকের কাছে। আমার ও আমার স্বামীর বয়সের পার্থক্য তখন ২০ বছর! এখন আমার বয়স ২৮ বছর। ভাবছেন হয়তো মেয়েরা বয়স কমিয়ে বলে। সত্যি বলছি আমার বয়স মাত্র ২৮। দেখে মনে হয় চল্লিশোর্ধ কোন মহিলা।
আমার ৪ মেয়ে! পেটে এখনও ৬ মাসের বাচ্চা। এটাও মেয়ে হবে।আমার পোড়া কপাল। শুধু মেয়েই হয়। পরপর পাঁচটা মেয়ে! কি অপরাধের শাস্তি যে আল্লাহ দিচ্ছেন!
- মেয়ে জন্ম দেয়া কোন অপরাধ নয়।
- কি বলছেন ভাই? মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই আজন্ম পাপ। আর মেয়ে জন্ম দেয়া হচ্ছে মেয়েদের সবচেয়ে বড় অপরাধ!
বিয়ের পর আমার স্বামীকে বলেছিলাম আমি ছাত্রী ভালো পড়াশোনা করতে দেন। কিন্তু আমার স্বামী রাজি হননি। বিয়ের পর আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার আর কোন মূল্যই থাকলো না। এমনকি যখন ইচ্ছা হতো তখনই আমার উপর হামলে পড়তো। যেখানে কোন ভালোবাসা ছিল না, ছিলো শুধু শরীরের চাহিদা মেটানো! এদিকে শাশুড়ি মায়ের ইচ্ছা তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে হবে। পড়াশোনা একটু করায় আমি জানতাম অল্প বয়সে বাচ্চা নেওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আমি শাশুড়ি মা কে এই কথা বলতেই। আমার স্বামী এসে আমাকে চরম মারলো। বললো "বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরুষ মানুষের। এখানে মেয়ে মানুষের কোন কথাই নাই।"
আর শাশুড়ি মা বললো "তোমার চেয়ে কম বয়সে আমি তিন বাচ্চার মা হয়ে গেছিলাম! উনাদের ইচ্ছায় আমি কনসেপ্ট করলাম। আমার স্বামী তখন বিদেশে চলে গেছে।
গর্ভাবস্থাতেও সংসারের সব কাজ কর্ম আমাকেই করতে হয়েছে।শাশুড়ি মা শুধু বসে বসে হুকুম। শাশুড়ি মায়ের যুক্তি, পোয়াতি অবস্থায় কাজকর্ম করলে শরীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। আর কম কম খেতে হবে তাহলে বাচ্চা ছোট হবে এবং প্রসবের সময় কষ্ট কম হবে। হঠাৎ একদিন আমার প্রসব বেদনা উঠলো। এমনিতে বয়স ছিল কম, দূর্বল শরীর তার উপরে কখনো কোন ডাক্তার দেখাতে পারিনি। সেইযাত্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেলাম। বাচ্চাটা আর পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো না।
এর ২ বছর পর আবার এক মেয়ের জন্ম দেই। বুঝতে পারছিলাম শাশুড়ি মা আর আমার স্বামী কেও খুশি হতে পারেননি। কিন্তু মুখে তেমন কিছু বললেন না। প্রথম মেয়ে কোলে থাকতেই পরের বছর আবার কনসেপ্ট করলাম। এবার শাশুড়ি মা বললো, " বংশে এবার ছেলে চাই"।
কিন্তু না এবারো মেয়ে হলো। দুই বাচ্চা কোলে নিয়ে সংসারের সকল কাজ আমাকে একাই করতে হতো। একটু সাহায্য কেও করেনি। পরের তিন বছর আমার স্বামী বিদেশে থাকায় কোনরকমে বেঁচে যাই। এরপর উনি বিদেশ থেকে একেবারে চলে আসেন।
আমি আবার কনসেপ্ট করলাম। এবার আল্লাহ একটা নয় একসাথে দুইটা জমজ মেয়ে দিলো! জন্মের পর পরই আমাকে যা না তা বলে গালমন্দ করলো। মেয়েগুলোকে বারবার চাইছিলো মেরে ফেলতে। শেষ পর্যন্ত আশেপাশের মানুষ এসে আমার স্বামীকে আটকায়। এরপর থেকেই প্রতিমূহুর্তে উঠতে বসতে আমার শাশুড়ি মা আমাকে কথা শোনান।
আর আমার স্বামী পান থেকে চুন খসলেই গায়ে হাত তুলেন। বাবার বাড়িতেও যেতে পারিনাই। মা একা কোনরকমে বেঁচে আছেন। বোনদের অবস্থাও আহামরি তেমন ভালো না। দুঃখগুলো শেয়ার করার মতো কেউ ছিলোনা। রাতে কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজে যেত, অনেক বার মরার কথাও ভাবছি। কিন্তু মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারি নাই। আমার মতো অভাগীর মৃত্যুও নাই।
কথাগুলো বলেই মহিলা আবার কাঁদতে লাগলো। আমি পকেট থেকে টিস্যু বের করে দিলাম।
- এই পার্কে কি করছেন?
- গতকালকে ক্লিনিকে নিয়ে আসে আমার স্বামী। রিপোর্ট দেখে ওরা বলেছে এবারো মেয়ে হবে। এই শোনো আমার স্বামী আমাকে ঢাকায় ফেলে গ্রামে চলে গেছে। পরে হাঁটতে হাঁটতে এই পার্কে ঢুকে পরি। সারারাত এই পার্কের ভিতরেই বসে কাঁটাইছি।
কথা গুলো বলে পরক্ষনেই মহিলা আবার কাঁদতে লাগলো। আমি অনেক ক্ষণ চুপ করে বসে ভাবলাম।
শেষে বললাম আমার বাড়িতে যেতে পারেন, বোনের মতো থাকবেন। বাড়িতে এক ভিখারি মা আছেন। রাস্তায় আগে ভিক্ষা করতেন এখন আমার সাথেই থাকেন। যাবেন আমার সাথে নাকি গ্রামে ফিরে যাবেন?
মহিলা বললো,
- না আমি গ্রামেই ফিরে যাব। আমার মেয়েদের আমি ছাড়া আর কেও নেই। বাবা তো থেকেও নেই। আপনি শুধু দয়া করে আমাকে বাসে তুলে দেন। আমার কাছে একটা টাকাও নেই।
- তাহলে তো নিশ্চয়ই সারা রাত কিছু খাওয়া হয়নি! আসেন আমার সাথে।
মহিলাকে হোটেলে নিয়ে নাস্তা করালাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম
গ্রামেই ফিরে যাবেন তাহলে?
- হ্যাঁ। মেয়ে মানুষের স্বামীর বাড়ীই শেষ ঠিকানা। মরলে স্বামীর বাড়িতেই মরবো।
- ঠিক আছে আমি যাওয়ার সব ব্যবস্থা করছি। তবে আমি যা বলব তাই শুনতে হবে। তাহলে আপনার জন্য ভালো হবে।
- ঠিক আছে ভাই।
আমি আমার এক পুলিশ বন্ধু আর এক ডাক্তার বন্ধুকে কল দিলাম।
ঘন্টাখানিকের মধ্যেই ওরা চলে আসলো। ওদেরকে সমস্ত ঘটনাবলি খুলে বললাম এবং কি করতে হবে বললাম। ওরা মহিলাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যায়। আমার ডাক্তার বন্ধু মহিলার স্বামী ও শাশুড়িকে বুঝালো যে সন্তান মেয়ে হবে নাকি ছেলে হবে তা স্ত্রীর উপর নয় এটা নির্ভর করে স্বামীর উপর। তাদের সকল ভ্রান্ত ধারণা আর কুসংস্কার দূর করার অনেক চেষ্টা করলো।
আর সবশেষে আমার পুলিশ বন্ধু শাসালো এই বলে যে, "
ফাতেমা আজকে থেকে আমাদের বোন। ভালোভাবে বুঝিয়ে যাচ্ছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন। যদি আমরা জানতে পারি কোনদিনও ফাতেমাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সোজা হাজতে।"
কয়েক মাস পর গতকাল ফাতেমা আমাকে ফোন দেয়।
- ভাই আমার একটা রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে! ক্লিনিকের রিপোর্টে ভুল ছিলো। আমার স্বামী আর শাশুড়ি মাও এখন অনেক খুশি। উনারা এখন ভালো হয়ে গেছেন। আমার আর আমার সন্তানদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। ভাই সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। আপনার জন্য আমরা সবাই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। আপনার ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারবনা। আপনার মতো ভাই যেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। আমার ছেলের নাম আপনি রেখে দেন।
আর আমার ছেলেকে দেখতে অবশ্যই টাঙ্গাইলে আসবেন। টাঙ্গাইলের চমচম খাওয়াবো আপনাকে।
-- আমার চোখে অশ্রু চলে আসলো। এ যে আনন্দ অশ্রু!
আমি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। আমি ছেলেটির নাম রাখলাম আনন্দ। তারপর ফোনটা রেখে দিলাম।
আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যেন দুনিয়ার সকল বোনেরা স্বামীর বাড়িতে সম্মানের সাথে ভালো থাকে।
(পৃথিবীর সকল মায়েরাই এমন। নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়ান।
নিজে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে পরম ভালোবাসায় সন্তানদের আগলে রাখেন। দুনিয়ার সকল মায়ের প্রতি তথা নারী জাতির প্রতি সম্মান জানাই।) ১৮ ই এপ্রিল আমার জন্মদিন উপলক্ষে এই গল্পটা সকল মায়েদের ও মেয়েদের উৎসর্গ করলাম।
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম
Comments
Post a Comment