বিকাল পাঁচটা।বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।গন্তব্য মাদ্রাসা।গতকাল তারাবীহ’র পর বাসায় এসেছিলাম সবার সাথে দেখা করার জন্য।মাদ্রাসা দূরে হওয়ায় তারাবীহ’পড়িয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠেনা।তাই বৃ্হঃস্পতিবার তারাবীহ’পড়িয়ে বাসায় আসি,এবং শুক্রবার আছর পড়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাই।ইফতার আম্মু সাথে দিয়ে দেন।কিন্তু আজ আম্মু অসুস্থ থাকায় ইফতার দিতে পারেননি। বাসা থেকে বের হয়ে চিন্তা করলাম,যেহেতু পথিমধ্যে ইফতার এর সময় হয়ে যাবে,তাই ইফতার নিয়ে নেওয়া দরকার। ভেবে চিনতে গ্রীল আর রুটি নিয়ে নিলাম।কুড়িল নেমে ঘড়িতে দেখলাম মাগরিব এর আজান এর আর পাঁচ মিনিট বাকি।ভাবলাম ইফতার করে আবার রওয়ানা হবো। ইফতার হাতে নিয়ে পাবলিক বেঞ্চে বসে আছি।কেমন যেন ইতস্থ বোধ হচ্ছে।মনে পড়ল,পানি আনতে ভুলে গেছি।মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।পানি ছাড়া ইফতার করা যায়?নিজেকে গালাগাল করতে করতেই পাশে তাকালাম,এবং যা দেখলাম তা কখনো ভুলবার নয়। চল্লিশোর্ধ একজন মহিলা রাস্তায় ছেঁড়া তেরপলে বসে আজানের অপেক্ষা করছে।তার সামনেও রয়েছে ইফতার।তবে তা আমার মত পেটপূজারীর বিলাসী ইফতার নয়।তা হচ্ছে পুরনো বোতলে এক বোতল পানি!!!!দূর মাসজিদ থেকে আযানের আওয়াজ ভেসে আসছে।ইফতার হাতে নিয়ে বসে আছি।খেতে ইচ্ছে করছেনা।নিজের অজান্তেই খাবার হাতে উঠে দাড়ালাম এবং এগিয়ে গেলাম সেই মহিলার দিকে।খাবার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম,”খেয়ে নিন।“তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।তারপরলেন,”তুমি খাইবানা বাজান?”আমি বললাম”আমি খেয়েছি,আপনি খান।“বলেই আমি হাঁটা শুরু করলাম।কারণ আনন্দাশ্রু নাকি কাউকে দেখাতে নেই।
২৭রামাজান।বাসায় বসে আছি।সকাল থেকে কিছুই ভাল লাগছেনা।বারবার পথাশ্রিত সেই মহিলার অবয়ব অন্তরে ভেসে উঠছে।গত সাতটি দিনও কি তিনি শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেছেন???জুম্মা পড়ে আম্মুকে বললাম,” ইফতার তৈরী করে দিন।আমি আসরের আগেই চলে যাব”।আম্মুতো অবাক!!আমাকে বললেন” গতকাল ই তোর তারাবীহ’খতম হয়ে গেছে।আজ আবার কোথায় যাবি?”।আমি হেঁসে বললাম,“ তৈরী করে দিন,পরে বলব।“আম্মু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
আসরের আগেই রওয়ানা হয়ে গেলাম।মাগরিবের বেশ কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম কুড়িল ।সামনে তাকাতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল।যার জন্য আসা,সেই ভদ্র মহিলা তার জায়গাতেই উপবিষ্ট আছেন। সামনে পরিচিত সেই বোতল ভর্তি পানি।সেই পাবলিক বেঞ্চে বসে ইফতারের অপেক্ষা করতে লাগলাম।আজান দিতেই সেই মহিলার দিকে এগিয়ে গেলাম এবং হাঁটু গেড়ে বসলাম।ব্যাগ থেকে ইফতার বের করে বললাম “আম্মু আপনার জন্য ইফতার দিয়েছেন,খেয়ে নিন।“আজ ও তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।কিন্তু কিছু বললেননা।আমি উঠে এসে বেঞ্চে বসে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।দেখি তিনি খাবারগুলো নিয়ে উঠে চলে যাচ্ছেন।হাটতে হাঁটতে সামনে থাকা ওভারব্রীজের নীচে চলে গেলেন এবং যা করলেন,তা একজন হৃদয়বান মানুষের পক্ষেই সম্ভব।ব্রীজের নীচে বসে থাকা বাচ্চাদের ডেকে একে একে সব খাবার দিয়ে দিলেন।আমি বজ্রহাতের ন্যায় দাড়িয়ে রইলাম।নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা।খালি হাতে ফেরার পথে তিনি আমার সামনে পড়ে গেলেন।আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।তিনি কৈফিয়তের সুরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন” ছোড মানুষ,ভালা জিনিস খাইতে মন চায়,আমি বুড়া মানুষ,এক বোতল পানি হইলেই চইল্লা যায়।“বলেই তিনি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।কি জানি!হয়তো তিনিও জানেন,”আনন্দাশ্রু কাউকে দেখাতে নেই!!!!”।
"মানবতা"
~যাকারিয়া হাসান
Comments
Post a Comment