রিফাত জানালার ধারে বসে আছে। বিকেলের বাতাস টা ভালোই লাগছে। নিচতলার মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। রিফাতের ওয়ার্ড চারতলায় হওয়ায় আশপাশের দৃশ্য ভালোই দেখা যায়। হঠাৎ নার্স এসে কেবিনে ঢুকলো।
-কি খবর!কেমন আছ রিফাত?
_এইতো ভালো।কয়েকদিন যে দেখলামনা আপনাকে?
-আম্মু খুব অসুস্থ, তাই ছুটি নিয়েছিলাম।
_এখন কি অবস্থা?
-কিছুটা ভালোর দিকে।
রিফাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল।রিফাত এই হাসপাতালে ভর্তি দুইমাস যাবত।এর মধ্যে কতরোগীকে সে ভর্তি হতে দেখেছে।কেউতো শয্যাশয়ীও ছিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন! তাদের প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে আপন নীড়ে। এখন রিফাতের ওয়ার্ডটাকে প্রায় খালি বলা যায়। এতে অবশ্য রিফাত খুশি। এখন মন চাইলে অন্য বেডে যেয়ে বসা যায়। আম্মু কিছু বললে রাগ করে অন্য বেডে শুয়ে থাকা যায়।
-রিফাত,নাস্তা কি খাবি বাবা?
_আজকে কিছু খাবনা মা,ভাল লাগছেনা।
-বাবা,প্রতিদিন তুই বিকালের নাস্তা নিয়ে জ্বালাতন করিস।বলনা কি খাবি?
_আমি যখন থাকবনা,তখন আর কেউ তোমাকে জ্বালাতন করবেনা।তুমি বিকালে নাস্তা এনে ডাকাডাকি করবে।কিন্তু দেখবে,রিফাত আর তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেনা।
শাহেদা বেগম চুপ করে বসে আছেন। রিফাত অসুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই এরকম কথা বলে।
_মা আজকে আমার রিপোর্ট দেওয়া কথা না?
-হ্যা বিভাগীয় অধ্যাপক আসলে ডাকবে আমাদেরকে।
মা জানো, আমি এখনই বলে দিতে পারব রিপোর্টে কি এসেছে। যদিও তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বলব মা?
শাহেদা বেগম উদাস দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে চেয়ে আছেন।ছেলেটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
_মা,আমার ক্যান্সার হয়েছে।
রাশেদা বেগমের মনে হল,পৃথিবীটা কেমন যেন স্থীর হয়ে গেছে। তিনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আশপাশে তাকালেন।রিফাত শূন্যদৃষ্টিতে বারান্দায় তাকিয়ে আছে।হঠাৎ রাশেদা বেগম হেচকি তুলে কান্না শুরু করলেন। অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন,“ তুই আমাকে ছুঁয়ে বল, কখনো আর এরকম কথা বলবি না। ”
রিফাতের কেমন যেন লজ্জা করছে। আম্মু এতগুলো মানুষের সামনে তার হাত ধরে কান্নাকাটি করছে। খারাপ যে লাগছে না তাও না।
_মা,কান্না বন্ধ কর।লোকেরা কি ভাববে?
-শাহেদা বেগম বললেন,”তুই বল,আর কোনদিন বলবিনা এই কথা।“
_আচ্ছা মা,আর বলব না।এবার কান্না বন্ধ কর।
এমন সময় নার্স এসে কেবিনে ঢুকলো।
-“অধ্যাপক এসেছেন আপনি এখন যেতে পারেন। ”বলেই নার্স বের হয়ে গেল। রিফাত বলল,
_ মা,আমি তোমার সাথে যাই?
-না বাবা এত কষ্ট করে তোর যাওয়ার দরকার নেই। আমি যেয়ে কথা বলে আসি। তোর জন্য নাস্তা কি আনব বল।
_তোমার যা ইচ্ছা, এনো।
সাহিদা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বাইরে চলে গেলেন। রিফাত ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ রিফাতের মনে হলো, সে তো বেশিদিন বাঁচবে না। আচ্ছা, যখন সে মায়ের চোখের আড়াল হবে,তখন কি মনেরও আড়াল হবে? রিফাত দাড়িয়ে অনেকক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর ওয়ার্ডে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করল। মাঝখান খুলে লেখা শুরু করল,
“আচ্ছা মা, আমি তোমাকে ছেড়ে গেলে তোমার কি খুব বেশি কষ্ট হবে? জানি তোমার কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে। জানো মা, আজ সকালে ভাবছিলাম আমি চলে গেলে তুমি কি করবে। সকালবেলা তুমি নাস্তা তৈরি করে ডাকাডাকি শুরু করবে। আমার সাড়া-শব্দ না পেয়ে তুমি ভাববে, আমি হয়তো রাগ করেছি। তুমি রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আমার রুমে যাবে। দেখবে, আমি নেই। ভাববে, হয়তো আমি ছাদে আছি। তুমি ছাদে আসবে। দেখবে রিফাত এখানেও নেই। তুমি নীচে এসে রাগ করে বসে থাকবে। বলবে“ কি এমন বলেছি যে, রাগ করে বাইরে চলে যেতে হবে? আসুক আজকে! তুমি অপেক্ষায় থাকবে। পেরিয়ে যাবে অনেক সময়। তাও আমি ফিরব না। হঠাৎ তুমি বুঝতে পারবে, যে রিফাত কে তুমি ডাকছো, সে আর ফিরবে না। তুমি কান্নাজুড়ে দিয়ে বলবে “কি এমন করেছি যে, আমায় ছেড়ে দূরে চলে গেলি?আমার রিফাত আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।ও আর আসবে না। কোনদিন আসবে না।”
রিফাতদের বাসা ঢাকার নারায়ণগঞ্জে।একতলা একটি ভবন।সামনে বড় উঠানে বিভিন্ন প্রকার গাছপালা দাড়িয়ে আছে।
রিফাতের বাবা মারা যাওয়ার সময় এটি রেখে গেছেন। রিফাতের বয়স তখন তিন বছর।শাহেদা বেগম নিজের সুবিধার্তে তার ভাইয়ের পরিবারকে এখানে নিয়ে এসেছেন। রিফাত কে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। রিপোর্টে ব্যাপারে শাহেদা বেগম রিফাতকে কিছু বলেননি। রিফাত বুঝে নিয়েছে, তার ধারনাই সত্য।
রিপোর্ট দেয়ার পর থেকে শাহেদা বেগম কেমন যেন হয়ে গেছেন। সব সময় ছেলের সঙ্গে থাকেন। এক মুহূর্তের জন্যও ছেলেকে চোখের আড়াল করেন না। এ বিষয়টা রিফাতের একদমই ভালো লাগে না। নিজেকে বন্দী বন্দী মনে হয়। রিফাত বিছানায় শুয়ে ভাবছে, এই বিষয়টা নিয়ে মাকে বলা দরকার।এমন সময় শাহেদা বেগম এসে ঘরে ঢুকলেন।
-বাবা, চল ছাদে যাই। রাতের তারা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
রিফাত অবাক হলো। প্রায়দিন সে মাকে ছাদে যাওয়ার জন্য বলে কিন্তু আজ মা!! রিফাত বলল,
_চল মা।
রিফাত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
_মা দেখো, তারাগুলো কিভাবে জ্বলছে।
শাহেদা বেগম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন।
_মা,যখন আমি চলে যাব,তখন আমার কথা মনে পড়লে তুমি রাতের আকাশে তাকাবে।দেখবে,লক্ষ তারার ছায়ায় বেঁচে আছে তোমার রিফাত।
-আচ্ছা বাবা,আমি যদি তোকে ছেড়ে চলে যাই,তুই কি রাগ করবি?
রিফাত চমকে উঠল।মা কি ডায়েরীটা পড়েছে?এজন্যই কি মা এরকম কথা বলল ?
_ মা, তোমার কি মন খারাপ ?
-চল বাবা, নিচে চলে যাই।”বলেই শাহেদা বেগম উঠে চলে গেলেন।রিফাত ছাদে একা বসে আছে । আচ্ছা সে কি ডাইয়েরীর লেখাটায় মাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? রিফাত ভাবলো “যাই, আম্মুর কাছে যেয়ে মাফ চেয়ে আসি।” কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল, এখন মাফ চাইতে গেলে আম্মু কান্নাকাটি করবে। মন আরও খারাপ হবে। তারচেয়ে বরং সকালে আম্মুর মন ভালো হলে মাফ চাওয়া যাবে। এতে আম্মুও খুশি হবেন।
*রিফাতের ঘুম ভাঙলো মৃদু কান্নার শব্দে ।রিফাত বিছানায় মন খারাপ করে বসে রইল। আজ তার জন্যই তো আম্মুর এত কষ্ট। রিফাতের মাঝেমধ্যে মনে হয়, সে মারা গেলেই মনে হয় ভালো। বেঁচে থেকে শুধু শুধু মাকে কষ্ট দিচ্ছে। রিফাত মনে মনে ভাবল, এবার মাকে কিছু শক্ত কথা বল উচিত। মা তো তার জন্য কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে।
_ মা, এই মা,কই তুমি? এদিকে এসো! পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রিফাত চেহারায় কঠোর একটা ভাব আনার চেষ্টা করলো।
_ আরে শেফালী খালা আপনি? কখন এসেছেন?
রিফাতের খালা রিফাতের পাশে এসে বসলেন।
খালা আপনিও কাঁদছেন? হয়েছে টা কি বলুন তো? আম্মুও সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে। ভাবটা এমন যেন আমি মরেই গেছি ।
- তোর মা কানলে তোর খারাপ লাগে?
_লাগেনা বুঝি?জানেন না,সবসময় চোখে চোখে রাখে।কি যে বিরক্ত লাগে!
হঠাৎ শেফালী বেগম রিফাতকে জড়িয়ে ধরলেন।
“-আর তোকে কেউ চোখে চোখে রাখবেনা।কেউ তোকে জ্বালাতন করবেনা।এখন থেকে আর কেউ তোর জন্য কাঁদবেনা।”বলেই শেফালী বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রিফাতের মনে হল,পৃথিবীটা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেছে। মা!!বলে চিৎকার দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো রিফাত।
*শাহেদা বেগম কে বাড়ির পাশে আমগাছের ছায়ায় কবর দেয়া হয়েছে। রিফাত দিনের বেশিরভাগ সময় তার মায়ের কবরে যেয়ে বসে থাকে। একাকী গল্প করে তার মায়ের সাথে। তার ধারণা, তার মা তার কথা শুনতে পায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদে যেয়ে বসে থাকে রিফাত।।তাকিয়ে থাকে দূর আকাশে।হয়তো মা কোন একদিন দেখা দেবে নক্ষত্রের ছায়া হয়ে।সেদিন সে মাফ চাইবে মায়ের কাছে। আচ্ছা, মা কি তখনো কাঁদবে??
গল্প ঃমায়া
~যাকারিয়া হাসান
Comments
Post a Comment