একটি বিয়ের গল্প ...
দুহাত ভরা মেহেদি ত্রপার হাতে । বাড়িতে পুরা সাজ সাজ রব । সব আত্মীয় স্বজন এসে পড়েছে । পরিবেশটার মধ্যেই যেন কেমন আনন্দ আনন্দ ভাব । ত্রপা ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে । ওর বড় বোন খুব যত্ন করে ওর হাতে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে । আগে মেহেদি দিলেই ত্রপার চিন্তা হতো মেহেদি বেশি লাল হবে তো ? কিন্তু আজ মেহেদি এতো লাল হয়েছে তবুও ত্রপার মনে কোন আনন্দ নেই । সামনে দুইটা শাড়ি । একটা লাল আর একটা গারো নীল । সবাই বলছে লাল শাড়ি পরতে কিন্তু ত্রপার ইচ্ছা করছে নীলটা পরার । হয়তো নীলের মধ্যে আলাদা কোন আকর্ষণ আছে ওর । ৪ সেট গয়নার বাক্স সামনে পরে আছে । কাজিনরা সবাই দেখছে কোনটা পড়লে বেশি ভালো লাগবে ওকে । কিন্তু ত্রপার যেন কিছুতেই খেয়াল নেই । কি যেন ভাবছে ও ।
বুঝছো বালিকা অনেক ভেবে দেখলাম তোমাকে বিয়ের দিন নীল শাড়িতেই বেশি সুন্দর লাগবে । দুহাত ভরা চুড়ি থাকবে । এই তুমি কিন্তু বেশি সাজবা না । এমনেই এতোগুলা সুন্দর তুমি পরে বিয়ের দিন তোমার ক্রাশ লিস্ট বেড়ে যাবে, বলতে বলতে হাসতে থাকে নিভৃত । যাহ কি যে বলেন না আপনি, বিয়ের দিন কেউ নীল পড়ে ? আমি তো ভাবছি বিয়ের দিন লাল পড়বো আর বউ ভাত এর দিন পড়বো সাদা গাউন । কেমন লাগবে ? ত্রপা জানতে চায় নিভৃত এর কাছে । দূর বিয়ের দিন নীল। আর বউ ভাত এর দিন সাদা পরলে পরতে পারো কিন্তু কেমন জানি বিধবা বিধবা ভাব এসে যায়, বলে হাসতে থাকে নিভৃত । এই চুপ, খুন করে ফেলবো উল্টা পাল্টা কথা বললে, ত্রপা মিথ্যা রাগ দেখায় । এইবার নিভৃত বলে দেখ এতো জলদি তোমার বিয়ে হইতেছে না । তাই এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু পড়ালেখা করো ।
প্রতিমার ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ে ত্রপার । এই তুই এখনো গয়না পরিসনি কেন ? বেশি সময় তো নেই আর। ত্রপা কিছু বলতে পারে না । প্রতিমা ওকে গয়না গুলো পড়িয়ে দিতে থাকে । আজ ত্রপার মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই । কতোটা দিন অপেক্ষা করেছে ও এইদিনটার জন্য । আজকের দিনে কতো সাজবে । কতো সুন্দর লাগবে ওকে । কিন্তু কেন জেনো সব এলোমেলো লাগছে ওর কাছে । সুন্দর সময় গুলো জেনো মিশে আছে বিষাদের কালো ছায়ায় । ঐদিকে শানাই এর শব্দ হচ্ছে, চারিদিক হটাত বেস্ত হয়ে উঠলো জেনো । হবেই তো এমন, আজ যে ত্রপার বিয়ে ...
নিভৃত ছাদে বসে আছে । আজ কেন জানি নিভৃত এর কিছুই ভালো লাগছে না । মোবাইলটা হাতে নিয়ে ত্রপার ছবি দেখছে ও । ঈশ কি সুন্দর মিষ্টি হাসি মেয়েটার । ওর চোখ গুলো এতো সুন্দর যে একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না । এই প্রথম আজ ত্রপাকে কোন ম্যাসেজ দেয়নি নিভৃত । আসলে আজ ওর সাহস হয়নি ত্রপাকে কিছু বলার । কীভাবে ম্যাসেজ দিবে? যদি ত্রপা বলে ফেলে কখন আসবেন আপনি আমার বিয়েতে ? বড্ড কঠিন একটা প্রশ্ন হবে যার উত্তর শুধু মিথ্যের মাঝেই দেয়া সম্ভব । আজকের দিনটা তো নিভৃত এর জন্য সবচেয়ে আনন্দের হতে পারতো কিন্তু... এই যে আপনার সে কেমন আছে ? কেমন চলে আপনাদের প্রেম ? ত্রপার দুষ্টু মাখা প্রশ্ন । আরে কি যে বলো না বালিকা, আমাদের তো প্রেম না, শুধু আমি ভালোবাসি ওকে, ও তো আর জানে না। তো জানে না বলে দেন, এতো ভয় পান কেন আপনি? ত্রপা রাগ দেখায় । নিভৃত বলে কীভাবে বলবো বল, আমি কি ওর জন্য পারফেক্ট ? কি আছে আমার ? ত্রপা বলে উঠে ধুর এতো ভাবলে প্রেম এ পরলেন কেন আপনি ? আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না। নিভৃত হাসতে থাকে । কিন্তু আজ যে আর নিভৃত হাসতে পারে না, আজ নিভৃত কাঁদছে । না পাওয়ার বেদনার থেকে না বলার বেদনাই প্রখর । নিভৃত বলতে পারেনি ত্রপা আমার সে অন্য কেউ নয় শুধুই তুমি । হয়তো কখনো বলতেও পারবেনা । সব কথা কি আর বলা যায়, কিছু জেনো না বলাই থেকে যায় ।
বর পক্ষ এসে গেছে । বরকে একবার দেখেছে ত্রপা। আর দেখতে ইচ্ছে করেনি ওর । এতো দেখে কি করবে ও ? এমন তো না যে ওর পছন্দ না হলে বিয়ে করতে হবে না । ত্রপার বান্ধুবিরা সব এসে গেছে। নাতাশা, কথা, তাশফিয়া । সবাই একে একে ছবির পর ছবি তুলছে ত্রপার সাথে। ত্রপা হাসি মুখে ছবি তুলে যাচ্ছে ওদের সাথে। ত্রপার জেনো কোন ক্লান্তি নেই । অন্যদিকে নিভৃত এর বন্ধুরাও এসেছে আজ । দ্বিপ, দর্পণ, তূর্য । ওরা আজ খুশি না তবুও মুখে হাসি হাসি ভাবটা ঠিকি ধরে রেখেছে । দর্পণ আজ নাতাশা, কথাদের সাথে খুনসুটি করছে না। আজ জেনো সব অন্যরকম লাগছে ওদের কাছে । সবাই ত্রপার সাথে দেখা করছে, কথা বলছে, ছবি তুলছে । কিন্তু ত্রপার চোখ বারবার আসে পাশে কিছু জেনো খুঁজছে । হয়তো নিভৃত কেই খুজছে ত্রপা । বালিকা, তোমায় আজ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে- এই কথাটা শোনার জন্য হলেও যে নিভৃত কে চাই ।
কাজি সাহেব এসে পরেছেন । বিয়ের সব কাজ শেষ করে ফেলেছেন তিনি। যখন ত্রপাকে বললেন কবুল বলতে তখন ত্রপার বুকটা কেমন জানি কেপে উঠলো । নিভৃত এর মুখ টা ভাসছে ওর চোখের সামনে । আচ্ছা কবুল না বললে কি হয় না? তাহলে হয়তো নিজে যেমন হাসতে পারবে তেমনি নিভৃত ও হাসবে ওর সাথে বাকি জীবনটা । হটাত ত্রপার চোখ যায় ওর বাবা মায়ের দিকে। আজ তাড়া অনেক খুশি । ভালো একটা পাত্রের সাথে যে ত্রপার বিয়ে দিতে পারছে তাড়া । ত্রপার চোখে নিভৃত এর ছবিটা ঝাপসা হতে থাকে । ত্রপাদের যে নিজেদের হাসতে নেই, অন্নের মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজেদের হাসিকে কবর দিতে জানে ত্রপারা । ত্রপারা কোন স্বপ্ন দেখে না, অন্নের একে দেয়া স্বপ্নে শুধু শেষ তুলির আঁচড়টুকু দেয় ওরা । ত্রপার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, বাবা মাকে ছেরে দূরে যাওয়ার জন্য নাকি নিভৃত নামে একটি স্বপ্নের মৃত্যুর জন্য তা ত্রপা নিজেও জানে না । একটু পর যন্ত্রের মতো তিনবার কবুল বলে ফেললো ত্রপা । হ্যাঁ অবশেষে ত্রপা পেরেছে। চারিদিকে মিষ্টি মুখ করানো চলছে । ত্রপা নীচের দিকে তাকিয়ে আছে । ত্রপার বর ওর সাথে এসে বসেছে । ত্রপার হাত ধরে রেখেছে, এমন কিছু ছবি যে তুলতে হবে সবার।
নিভৃত বসে আছে । পাশেই তো ত্রপার বাসা । শানাই এর সুর যে ও এখান থেকেও শুনতে পারছে । না নিভৃত কাঁদতে পারছে না । ওর মনে শুন্যতা ছাড়া কিছুই নেই । হয়তো সব শেষ । আচ্ছা নিভৃত কেন বলতে পারলো না ত্রপাকে? নিভৃত কেন পেলো না ওকে ? আজ নিভৃত এর কিছু নেই বলে? কিন্তু কাল তো নিভৃত এর সব থাকতেও পারে? হায় স্বার্থপর দুনিয়া । কাল তোমার কি হবে তা নিয়ে যে ভাবার সময় নেই কারো বরং আজ তোমার কি আছে তা দিয়েই তোমার বিচার করা হবে । নিজের অপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিভৃত এর । মোবাইলটা রাগ করে ছুঁড়ে ফেলো দিলো ও । কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে এক মোবাইল না থাকলেই কি সব ভুলে যাবে ও? ওর বুকের বাম পাশের সবটা জুড়েই যে শুধু ত্রপা । না চাইলেও ত্রপাকে আলাদা করা যাবে না, থাকা যাবে না ভুলে । তবে কি হবে? হাসতে থাকে নিভৃত । সবাই তো স্বার্থপর তবে আমি কেন হবো না ? মনে হয় ছাঁদ থেকে লাফ দিক একটা । সব কিছু তখন না হয় ভুলে থাকা যাবে । কিন্তু না নিভৃত পারে না । নিভৃতরা না পারে বেঁচে থাকতে না পারে মরে যেতে । মৃত মন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত । নিভৃত বড্ড একা হয়ে দাড়িয়ে আছে ছাঁদের কিনারা ধরে । না নিভৃত একা না, আঁকাসে চাঁদ দেখা যাচ্ছে । হয়তো চাঁদ ও আজ নিভৃত কে উপহাস করে বলছে ওরে বোকা চাঁদ তো সবাই ছুঁতে চায় কিন্তু কেউ কি পারে ??? ...
ত্রপা গাড়িতে উঠে বসেছে । চোখের পানি মুছে ফেলেছে ও । ওর তো কান্না করলে চলবে না । কতো মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে হবে ওর । একজন নিভৃত এর জন্য সবাইকে কান্না করাতে পারবে না ও । গাড়ি ছুটে চলেছে স্বপ্নকে পিছনে ফেলে রেখে । ত্রপা চুপ করে ভাবছে, কি ভাবছে? যাহ একজন নিভৃত এর গল্প মনে রাখতে বয়েই গেছে ত্রপার .........
Enoy Hasan
Comments
Post a Comment